খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, খাদ্য নিরাপত্তা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও বাংলাদেশ

0
1839

ভৌগলিক অবস্থানগত কারনে বাংলাদেশ একটি দূর্যোগ প্রবণ দেশ। এখানে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ  আমাদের নিত্য সাথি। আমরা প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের মেকাবিলা করে থাকি। ইতঃপূর্বে আমরা ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের উপর্যুপরি বন্যার মোকাবেলা যেমন করেছি; তেমনি করেছি ১৯৯৮ সালে দীর্ঘস্থায়ী বন্যারও। ২০০৭ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় “সিডরের” ক্ষত শুকাতে না শুকাতে আবারও ২০০৯ সালে “আইলার” মত ভয়াবহ ঘূর্ণিঝরের কবলে পরে বাংলাদেশ। পত্রিকান্তরে জানা যায় এ পর্যন্ত “সিডর” এবং “আইলার” ক্ষতিগ্রস্থদের যথাযথ পূর্নবাসন, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হয়ে উঠেনি। কাজেই বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগ ছাড়া বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না।

এবার ২০১৭ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ “বন্যা” নিয়ে কিছু সমস্যা, সমাধান ও করণীয় নিয়ে কথা বলা যাক:

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ উল্লেখ করার মত ভয়াবহ কোন বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্মূখীন হয়নি। যা সামান্য কিছু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে তাও সফলভাবে মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিল। বিশেষ করে “দানা শস্য” উৎপাদনে বাংলাদেশের সফলতা ছিল ঈর্ষনীয়। পাশাপাশি মৎস্য সেক্টর ও প্রাণী সম্পদ সেক্টরের সফলতা ছিল উল্লেখ করার মত। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যখন খাদ্য সংকট থেকে অনেক দূরে; সংগত কারনে খাদ্যের পুষ্টিমান, খাদ্য রপ্তানী নিয়ে চলছিল নানা পরিকল্পনা, ঠিক তখনই নেমে আসে ২০১৭ সালের বন্যা। শুরুটা ২০০৭ সালের মার্চ মাসে। যখন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাওর এলাকা, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা ও নিম্নাঞ্চলের মানুষ আধা-পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে বিভোর; বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটার প্রস্ততি নিচ্ছিল ঠিক তখনই আসে মহাবির্পযয়। ২০১৭ সালের মধ্য মার্চ থেকে শুরু হওয়া বিরামহীন বৃষ্টি ও পাহাড়  ঢলে তলিয়ে যায় হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি। অকাল এ বন্যায় নষ্ট হয় কয়েক লক্ষ ম্যাট্রিক টন বোরো ধান; ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর অঞ্চলের মৎস্য সম্পদ ও প্রানি সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ধান ক্ষেতের ধান গাছ পচে যাওয়ায় মড়ক শুরু হয় মাছের, মড়ক শুরু হয় বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ প্রাণী সম্পদের। ফলে পরিবেশ বিপর্যস্ত  হয় দারুণ ভাবে। যেখানে ২০-২৫ দিনের মাথায় নতুন ফসলে ভরে উঠবে কৃষকের গোলা, পরিশোধ হবে হবে বোরো ফসলের জন্য নেওয়া ঋণ, ব্যবসায়ী করবেন ধান বেচা-কেনার ব্যবসা, ঠিক সেই মূহুর্তে এমন বিপর্যয়ে হাওড় অঞ্চলের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হয়ে পরেন দিশেহারা। ধ্বংস হয়ে যায় হাওড় অঞ্চলের বোরো ফসল অর্থনীতি। শুধুই তাই নয় বন্যার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া অন্যান্য অঞ্চলের ধান ক্ষেতে “ব্লাস্টসহ” অন্যান্য রোগের প্রাদূর্ভাব এবং পোকা আক্রমণের ফলে উৎপাদন কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। ধান ফসল উৎপাদনের অন্যতম মৌসুম বোরো মৌসুমে উৎপাদন বিপর্যয়ে খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতির সংকায় পড়ে বাংলাদেশ।

ধান ফসল উৎপাদনের আরেক মৌসুম আমন। এ মৌসুমে অধিক উৎপাদনের আশায় বুক বাঁধে বাংলার কৃষক। সেই লক্ষ্য হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি শুরু করেন বাংলার মানুষ। শুরু হয় বিপুল উদ্দিপনায় আমন রোপনের কাজ, জুলাই মাসে শুরু হয় আবারও অতিবর্ষণ। পাহাড়ি ঢলে ডুবে যায় আমন ফসল। জুলাই মসের এ বন্যায় ক্ষতি ছিল পূরন যোগ্য। কিন্তু আগষ্ট মাসের অতিবর্ষন  ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় মহাবিপর্যয়ে পড়ে বাংলাদেশ। বোরো উৎপাদনে বিপর্যয় যখন হয় তখন আমাদের খাদ্য মজুদ ছিল ৩ লাখ টনেরও কম। যা ১৭ কোটি মানুষ অধ্যুষিত বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একেবারে নগন্য। সরকার খাদ্য মজুদ বৃদ্ধির  জন্য  বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ কর্মসুচি ঘোষণা করেন। কিন্তু সংগ্রহ মূল্য বাজারের ধান/চালের মূল্য বেশি থাকায় অধিকাংশ মিল মালিক ধান/চাল সরবারহে  সরকারের সাথে চুক্তি করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। কিছু সংখ্যক চালকল মালিক সরকারের সাথে চুক্তি করলেও ধান/চাল সরবারহ করেন খুবই সামান্য। ফলে বোরো মৌসুমে সরকারের ধান/চাল সংগ্রহ সম্পূর্ণ ব্যর্থই বলা যায়। বিলম্ব হলেও সরকারের বোধোধয় হওযায় ইতোমধ্যে ভিয়েতনামের সাথে চাল আমদানির জন্য চুক্তি/চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিছু চাল বাংলাদেশে পৌঁছেছে। কিছু চাল পৌঁছানোর অপেক্ষায়। তাছাড়াও থাইল্যান্ডের সাথে ১০ লক্ষ টন চাল আমদানির সমঝোতা চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। চাল আমদানিতে প্রথম দফায় ২৮% থেকে কমিয়ে ১০% এবং সর্বশেষে ২% আনায় দেশে ভারত ও মায়ানমারসহ অন্যান্য দেশ থেকে চাল আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

সরকরের ভাস্যমতে চলতি বছরে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাড়াবে ২০ লাখ ম্যাট্রিক টন। ইতোমধ্যে ১৫ লাখ ম্যাট্রিক টন খাদ্য আমদানির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো কারণ নেই। পক্ষান্তরে বেসরকারী হিসিবে চলতি বৎসরে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৩০ লাখ ম্যাট্রিক টন। খাদ্য ঘাটতি নিয়ে বির্তক যাই থাকুক না কেন দেশে যাতে খাদ্য ঘাটতি না হয়, আপামর সাধারণ মানুষ যাতে খাদ্যের অভাবে না পড়ে সেদিকে নজর দেওয়ায় সরকারের প্রধান/অন্যতম কর্তব্য।

আশার খবর এই যে, এই লেখাটি যখন লিখেছি তখন মাননীয় প্রধান মন্ত্রী উত্তর বঙ্গের বেশ কয়েকটি জেলায় সফর করেছেন এবং ত্রাণ সামগ্রী ও কৃষি উপকরণ বিতরণ করেছেন (ধানের চারাসহ)। আমাদের দেশে নদীর উপকূলে যাদের বাস তারা সাধারনত নাবী জাতের আমন চাষ করে থাকেন। তাদের জন্য এ ধরনের চারা ও কৃষি উপকরণ অত্যন্ত ফলদায়ক হবে। তাছারাও অনেক সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ত্রাণ সামগ্রীর সাথে ধানের চারাও বিতরণ করছেন যা আমন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সহায়ক। একেবারে কিছু উৎপাদন না হলেও গো খাদ্যের চাহিদা মেটাতে অনেক সহায়ক হবে।

বন্যায় উত্তর কৃষি পূনর্বাসন কর্মসূচি ইতোমধ্যে হাতে নিয়েছেন সরকার। বর্ন্যাত কৃষকদের স্বার্থে তথা দেশের স্বার্থে এ কর্মসূচি সফলতা কাম্য। পরিশেষে আগামীতে এরূপ দূর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি এখন থেকে নেওয়ার প্রত্যাশা করছি।

 

মো. জোনাব আলী

অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (অব.), বিএডিসি