হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি কি?
হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি হচ্ছে মাটি ছাড়া শুধুমাত্র পানি ব্যবহার করে ঘাস এবং সবজি উৎপাদনের একটি আধুনিক পদ্ধতি। তবে কখনো কখনো পানির সাথে সামান্য পুষ্টি উপাদানও ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে সবুজ ঘাস, শাক সবজি, ফল-মূল ইত্যাদি উৎপাদন করা যায়। সাধারনত গম, ভুট্টা ও যবের বীজ দিয়ে মাত্র ৭-৮ দিনে গবাদিপ্রাণির খাওয়ার উপযোগি ঘাস সারা বছরব্যাপী উৎপাদন করা যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক আগে থেকেই এ ধরনের চাষাবাদ হয়ে আসছে; যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, কেনিয়া, ফিলিস্তিনসহ আরো অনেক দেশে। তবে আমাদের দেশেও এই প্রযুক্তিটি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। অধ্যাপক ড. এম. এ. সালাম বাংলাদেশে ২০১১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এই প্রযুক্তির উপর গবেষণা শুরু করেন । এরপর তিনি দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলায়, বিশেষত যেখানে লবণাক্ততার কারণে সবুজ ঘাসের অভাব রয়েছে সেখানে কৃষক এবং খামারীদের মাঝে এই প্রযুক্তি সম্প্রসারণ শুরু করেন যা বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।
কেন হাইড্রোপনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবো:
১. আপদকালীন সময় ছাড়াও সারা বছর এই পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করে সহজেই গবাদিপ্রাণির খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করা যায়
২. দানাদার বা শুকনো খাবারের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে
৩. অল্প জায়গায় কয়েকটি ট্রে ব্যবহার করে প্রতিদিন ঘাস উৎপাদন করা যায়
৪. এই পদ্ধতিতে ঘরে বা বাড়ির আঙ্গিনায় ঘাস উৎপাদন করা যায় বলে কোন উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না
৫. স্বল্প খরচে এই ঘাস উৎপাদন করা যায়
৬. এই ঘাসে অধিক পুষ্টিগুণ থাকে যা গবাদিপ্রাণির হজম শক্তি বাড়ায়, দ্রুত ওজন বৃদ্ধি করে ও পুষ্টিহীনতাজনিত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে
৭. ব্যক্তি/ কমিউনিটি পর্যায়েও এই পদ্ধতিতে সবুজ ঘাস সহজেই উৎপাদন করা যায়
৮. স্বল্প মূলধনে এই পদ্ধতিতে ঘাস চাষ করে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ করা যায়
৯. গবাদিপ্রাণি ছাড়াও গৃহপালিত অন্যান্য প্রাণি এবং হাঁস মুরগীকে এই ঘাস নিয়মিত খাওয়ালে রোগবালাই নিয়ন্ত্রন এবং দেশে মাংস ও ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়াও কচি ঘাসের রস বা জুস মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। বোম্বে হাসপাতালের ডাক্তার মারোহা ব্লাড ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা হিসেবেও এই গমের চারার জুস ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন। তাছাড়া, যে কোন প্রকার কাটাছেঁড়া এবং ঘায়ের মাঝে এই গমের চারার জুস বা রস ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক উপকার পাওয়া যায়।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ঘাস চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ:
১. ভাল মানের গমের বীজ (সুস্থ সবল পোকামুক্ত)
২. গ্যালভানাইজড শিটের ট্রে বা প্লাষ্টিকের অফিস ট্রে
৩. পলিথিন
৪. পাতলা সুতি কাপড়/চট/পাটের বস্তা
৫. লবন
৬. চা চামচ
৭. খাবার সোডা/ ব্লিচিং পাউডার
৮. পানি স্প্রে করার জন্য বোতল/ছিদ্রযুক্ত মগ
৯. কাঠের/বাঁশের পাতলা কাঠি
চাষ পদ্ধতি:
১ম ধাপ: বীজ সংগ্রহ ও বাছাই পদ্ধতি
করনীয় ও সতর্কতা :
১. ভাল মানের গমের বীজ সংগ্রহ করতে হবে। নষ্ট বীজ ফেলে দিতে হবে।
২. ফসল তোলার সময় যেহেতু গম সহজলভ্য তাই এসময়ে গম সংগ্রহ করে ভাল করে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে নতুন গমে (প্রথম ২-৩ মাস) অংকুরোদগম কম হয়।
৩. যদি বীজ ভেজা থাকে সেক্ষেত্রে রোদে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
৪. অতঃপর বীজগুলো ৩-৪ বার ভালভাবে ধুতে হবে, ধোয়ার সময় ভেসে উঠা বীজ ফেলে দিতে হবে। গ্রীষ্মকালে ছত্রাক প্রতিরোধের জন্য বীজ ধোয়ার সময় প্রতি লিটার পানিতে এক চা চামচ পরিমান ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
৫. বীজ ধোয়ার পর একটি পাত্রে ১২ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি লিটার পানিতে আধা চা চামচ খাবার লবণ মিশিয়ে বীজের চেয়ে ২-৩ ইঞ্চি বেশি পানি রাখতে হবে।
২য় ধাপ : বীজ মুড়িয়ে/ পোটলা বেঁধে রাখার পদ্ধতি
করণীয় ও সতর্কতা :
১. ১২ ঘন্টা পর বীজ পুনরায় ধুয়ে পানি ঝরিয়ে সুতি কাপড় বা চটের ব্যাগে মুড়িয়ে/ পোটলা বেঁধে ২৪ ঘন্টা ঠান্ডা জায়গায় ঢেকে রাখতে হবে।
৩য় ধাপ: ট্রেতে গমের বীজ বিছানো
করণীয় ও সতর্কতা :
১. পুটলি বাঁধা বীজ ২৪ ঘন্টা পর একটি ট্রেতে সমানভাবে বিছিয়ে দিয়ে একটি ছালার চট বা সুতি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
২. ২ ফুট লম্বা, ১ ফুট চওড়া ও ২ ইঞ্চি উচ্চতার ট্রে’র ক্ষেত্রে ৩০০ গ্রাম পরিমাণ বীজ সমানভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে।
৩. ট্রে’র চওড়ার দিকের এক পাশে ৪-৬টি ছিদ্র করে দিতে হবে যেন পানি সহজে বেড়িয়ে যেতে পারে। বীজ ছড়ানোর সময় ছিদ্র থেকে এক ইঞ্চি দূরে রাখতে হবে যাতে শিকড় ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে না পারে।
৪. এবার ছড়ানো বীজে হালকাভাবে পানি স্প্রে করে ট্রে-টিকে একটি চট বা ঢাকনা দিয়ে ৩-৪ দিন ঢেকে রাখতে হবে।
৫. ট্রে-টি এমনভাবে ঢেকে রাখতে হবে যেন চটের বা কাপড়ের নিচ দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে।
৬. ট্রে-টিকে ভালভাবে কাত করে রাখতে হবে যেন ছিটানো পানি ট্রেতে না জমে গড়িয়ে ছিদ্র দিয়ে পড়ে যায়।
৭. এ অবস্থায় ঢাকনা খুলে দিনে ২-৩ বার পানি স্প্রে করতে হবে। তবে কখনোই যেন অতিরিক্ত পানি ট্রেতে জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৪র্থ ধাপ : বীজ অংকুরোদগমের পরের পরিচর্যা পদ্ধতি:
করণীয় ও সতর্কতা:
১. ৩-৪ দিন পর ট্রে’র ঢাকনা খুলে বাতাসে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এ অবস্থায় দিনে ৩-৪ বার পানি স্প্রে করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে কোন অবস্থায় গমের ট্রেতে যেন সরাসরি সূর্যের আলো না পড়ে এবং চারা যেন শুকিয়ে না যায়।
২. যদি ছত্রাকের আক্রমন দেখা যায় তবে ১ লিটার পানিতে ১ চা চামচ বা ৫ গ্রাম খাবার সোডা মিশিয়ে দিনে ৪-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
৩. ট্রে রাখার স্থানে পর্যাপ্ত আলো এবং বাতাসের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. দর্শনার্থী চলাচল সীমিত রাখতে হবে। তাছাড়া যখন তখন চারা উল্টিয়ে শিকড় প্রদর্শন করা যাবে না।
৫. ঘাস ধরার আগে হাত ভালভাবে পরিস্কার করে নিতে হবে।
৫ম ধাপ : ঘাস সংগ্রহ এবং গবাদিপ্রাণিকে খাওয়ানোর পদ্ধতি:
করণীয় ও সর্তকতা :
১. ৭ম/৮ম দিন বয়সের ঘাস (শিকড়সহ) পানিতে ১-২ বার ধুয়ে একটি পরিস্কার জায়গায় গবাদিপ্রাণিকে খেতে দিতে হবে।
২. একটি পূর্ণবয়স্ক গরুকে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি দিনে ১-২ কেজি পরিমান ঘাস খাওয়াতে হবে।
সম্ভাব্য প্রতিবন্ধকতাসমূহ :
১. স্থানীয় বাজারে খুব ভাল ও উন্নত মানের বীজের অপ্রতুলতা
২. ফাংগাস/ ছত্রাকের আক্রমন
৩. অতিরিক্ত গরম বা ভ্যাপসা আবহাওয়ায় ঘাস সঠিকভাবে না গজানো
৪. বদ্ধ ঘরে ছত্রাকের আক্রমনের সম্ভাবনা বেশি
করণীয় :
১. একবার ঘাস সংগ্রহের পরে সকল উপকরণ গরম পানি বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
২. ট্রে’তে যেন মরিচা না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
৩. ভাল বীজের জন্য অভিজ্ঞ কৃষক বা কৃষি ব্লক সুপারভাইজারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
৪. ঘাস উৎপাদনে কোন সমস্যা বা প্রাণির কোন রোগবালাই দেখা দিলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
৫. যদি ঘাসে অতিরিক্ত ছত্রাক দেখা যায় তবে সে ঘাস প্রাণিকে না খাওয়ানোই ভাল।
৬. ঘাস উৎপাদনের জায়গায় শিশুদের চলাচল বন্ধ রাখতে হবে।
৭. ফসল তোলার সাথে সাথে বীজ সংগ্রহ করতে হবে।
৮. খেয়াল রাখতে হবে ট্রে’র ছিদ্র যেন কোনভাবেই বন্ধ হয়ে না যায়।
৯. ট্রে এমন জায়গায় বসাতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত আলো বাতাস চলাচল করে।
১০. ট্রে ও শেলফ তৈরির জন্য স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য উপকরণ (বাঁশ, কাঠ, কলাপাতা, প্লাস্টিকের ট্রে, কাপড় ইত্যাদি) ব্যবহার করা যেতে পারে।
১১. ব্যবহৃত পানি পুনরায় ব্যবহার করার জন্য জমিয়ে রাখা যাবে না। প্রত্যেক বার নতুন স্বচ্ছ পানি ব্যবহার করতে হবে। বীজ ধোয়ার পানি ঘাসের চারায় ছিটানো যাবে না।
১২. যথেষ্ট আলো বাতাসের চলাচল থাকার পরও যদি ঘাসের চারায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় তখন বীজ পরিবর্তন করতে হবে।
১৩. মনে রাখবেন, ঘাসের চারা সম্পূর্ন ছত্রাক মুক্ত করা যাবে না। একটু আধটু ছত্রাক থাকবেই। তবে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে ছত্রাকের আক্রমন নিয়ন্ত্রন করে সীমিত পর্যায়ে রাখা যায়।
কৃষিবিদ ইমাম মেহেদী হাসান
বি,এস,সি,এজি. (অনার্স), এম,এস ইন প্লান্ট প্যাথলজি, পি,জি,ডি ইন সি,এস,ই,
সিনিয়র সেক্টর এনালিস্ট, ব্রাক
*ছবিসূত্র: ইন্টারনেট