কৃষি কাজ ওমহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশনা
কৃষি হচ্ছে মূলত সুসংগঠিত পদ্ধতি যা উদ্ভিদ হতে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে কৃষি সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, কারণ বিশ্বব্যাপী আর্থসামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কৃষিব্যবস্থার অগ্রগতি অন্যতম প্রধান নিয়ামক। শিল্পবিপ্লবের আগ পর্যন্ত পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল। নিত্যনতুন কলাকৌশল উদ্ভাবন এবং প্রয়োগের ফলে কৃষিজ উৎপাদন বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ সমস্ত কলাকৌশল নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
বর্তমানে অনেক বিষয় কৃষির অন্তর্ভুক্ত, এর প্রধান বিষয়গুলো হচ্ছে-
- কৃষিবিদ্যা (চারা উৎপাদন, রোপণ এবং ফসল সংগ্রহ)
- পশুপালন বিদ্যা
- মৎস্যবিজ্ঞান
- উদ্যানপালন বিদ্যা (স্বল্প পরিসরে ফুল, ফল, সবজি চাষ)
এ সমস্ত বিষয়ের প্রত্যেকটিরই আবার অনেকগুলো শাখা রয়েছে; যেমন কৃষিবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম চাষাবাদ পদ্ধতি, পশুপালনবিদ্যার অন্তর্ভুক্ত রেঞ্জিং (নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির পশুপালন পদ্ধতি)। কৃষিবিদ্যার উন্নয়ন এবং বিবর্তনের ফলে নতুন অনেক কৃষিপণ্য তৈরি হয়েছে যেমন: পশুখাদ্য (স্টার্চ, স্যুগার, এলকোহল ও রেজিন), তন্তু (তুলা, পশম, শন), ফ্লাক্স (লিলেন কাপড় তৈরিতে ব্যবহৃত) এবং রেশম জ্বালানি (জৈব পণ্যজাত মিথেন, ইথানল, বায়োডিজেল), পাতাবাহার, কাটফ্লাওয়ার (কাটার অনেকক্ষণ পরেও সতেজ থাকে এমন ফুল) এবং অন্যান্য নার্সারীর উদ্ভিদ।
১৯৯৬ সালের এক হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীর প্রায় ৪২% শ্রমিক কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল যা ২০০১৬ সাল নাগাদ কমে ৩৩% এ দাঁড়ায়। শিল্পায়নের ব্যাপক প্রসারের ফলে পৃথিবীর সর্বাধিক পরিচিত এ পেশার আপেক্ষিক গুরুত্ব দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং নিয়োজিত শ্রমিকের সংখার দিক থেকে ২০০১৬ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মত পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে কৃষিখাতকে টপকে যায় সেবাখাত। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে মোট জিডিপির পাঁচ শতাংশেরও কম আসে কৃষিখাত থেকে।
কোরাআনের আলোকে কৃষি:
‘গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক সুরক্ষায় কৃষি’ এ প্রতিপাদ্য নির্ধারণের মাধ্যমে সারা বিশ্ব পালন করছে এবারের বিশ্ব খাদ্য দিবস। ইসলামে কৃষি সুরক্ষায় রয়েছে সুস্পষ্ট ও সুন্দর দিক নির্দেশনা। যা দারিদ্র্য বিমোচনে অত্যন্ত কার্যকরী। কৃষি উৎপাদনকে বিশ্বমানবের প্রতি মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা জুমআর ১০নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা জীবিকা অন্বেষণে (কাজ-কর্মের জন্য) পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো।’ কৃষি কাজ করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শও বটে। কোনো ভূমি যেন পরিত্যক্ত বা অনাবাদি না থাকে, সে জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জমি আবাদ কর আর যে ব্যক্তি নিজে আবাদ করতে না পারে, সে যেন ভূমিটিকে অন্য ভাইকে দিয়ে দেয়, যাতে সে আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’ কুরআনে এসেছে- ‘তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য। এতে আছে ফলমূল আর রসযুক্ত খেজুর বৃক্ষ এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধি গুল্ম।’ (সূরা আর-রহমান : আয়াত ১১-১২)
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দ্বারা আমি সর্বপ্রকার উদ্ভিদেররা চারা উদ্গম করি, অনন্তর তা হতে সবুজ পাতা উদ্গত করি, পরে তা হতে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্য-দানা উৎপাদন করি এবং খেজুরগাছের মাথি হতে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি আর আঙুরের উদ্যান সৃষ্টি করি এবং জলপাই ও দাড়িম্বও; এরা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও; লক্ষ করো! এর ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং এর পরিপক্বতা প্রাপ্তির প্রতি। বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত-৯৯)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা থেকে আগুন প্রজ্বলিত করো।’ (সূরা ইয়াছিন, আয়াত: ৮০)
আল্লাহ তাআলা বন-জঙ্গল ও বৃক্ষরাজির মাধ্যমেই বায়ু সঞ্চালন করেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানোর জন্য ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন এবং জীবজগৎকে বাঁচিয়ে রাখেন। মানবজাতির জীবনধারণের জন্য সর্বাবস্থাতেই বৃক্ষরাজির বিশেষ প্রয়োজন। ব্যাপক বৃক্ষরোপণ ও সামাজিক বনায়ন না করে কেবল কেটে কেটে কাজে ব্যবহার করায় ধরণিতে বৃষ্টির অভাব, পৃথিবীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। যেহেতু পারিবারিক, সামাজিক ও আন্তর্জাতিকভাবে দৈনন্দিন কাজে এবং আসবাবপত্রের জন্য গাছপালা ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেহেতু একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ইসলাম কাউকে ফলবান বৃক্ষ নিধন বা কর্তনের অনুমতি দেয় না। কারণ, এতে অন্যরা বৃক্ষের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হবে। তাই অকারণে বৃক্ষ ছেদন বা কর্তন করা যাবে না। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অকারণে একটি কুলগাছ কর্তন করবে, আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন।’
পরিশেষে…
কুরআন-হাদিস ও ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে যুগে যুগে এ নির্দেশনা মোতাবেক সব নবী-রাসুলগণ কৃষি কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। হজরত আদম, ইব্রাহিম, লুত, শুআইব আলাইহিস সালামসহ সব নবী-রাসূলগণ এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম পশুচারণ, দুধবিক্রি, কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কৃষি কাজের ক্ষেত্রে ইসলামের দিকনিদের্শনা মেনে চলার তওফিক দান করুন। আমিন।