চেরি টমেটো চাষে লাখপতি: বিঘাপ্রতি ফলন ৫ টন !!!

0
7685
গাছ ভর্তি চেরি টমেটো

রূপে-গুনে অতুলনীয়, স্বাদে অনন্য, আঙ্গুরের মত থোকায় থোকায় নান্দনিকভাবে ঝুলে থাকা অসাধারণ একটি সবজী “চেরি টমেটো”। দেখতে আংগুরের মত হলেও পুষ্টিমান আঙ্গুরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, বরং চেরি টমেটোর পুষ্টিমান আঙ্গুরের থেকেও অনেক বেশী। রয়েছে অসাধারণ স্বাদ যা রসনা-বিলাসীদের জন্য রসনাবিলাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। অতি উচ্চ ফলনশীলতা, দীর্ঘ্য সময় ধরে ফলন হওয়া, কম পচনশীলতা ও বাজারে উচ্চ চাহিদা থাকার কারণে চেরি টমেটো চাষ নতুন খামারীদের জন্য হতে অপার সম্ভাবনার উৎস। একেবারেই অল্প বিনিয়োগে অনেক বেশী মুনাফা অর্জন করা সম্ভব এই টমেটো চাষের মাধ্যমে। চেরি টমেটো আমাদের দেশের আবহাওয়ায় চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সামনে শীতকাল আসছে। শীতকালে চেরি টমেটো সবচেয়ে ভালো জন্মে। তাই বলা যায় চেরি টমেটো চাষে লাখপতি হন কেননা বিঘাপ্রতি ফলন ৫ টন। অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই সবজী চাষ নিয়েই আমাদের সফল খামারীর আজকের আয়োজন।

পরিচিতি:

চেরি টমেটো মূলত ছোট জাতের টমেটো। ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে এই সবজির চাষাবাদ শুরু হয়ে পরে ১৯২০ সালের দিকে অধিকহারে বিস্তার লাভ করে। যা ধীরে ধীরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন উপায়ে এর জাতোন্নয়ন করা হয়। এই টমেটোর মিষ্টতা ৯-১০% হলেও আমাদের দেশে তা অনেক বেশী। কৃষি মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের আওতাভুক্ত সমন্বিত মানসম্পন্ন উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এর উৎপাদন ও সম্প্রসারনের জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গত ৩/৪ বছর হতে এই প্রকল্পের অধীনে এর চাষাবাদ শুরু করা হয়েছে। যা ইতিমধ্যে দেশে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে ৪৩টি হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে এর সম্প্রসারণের কাজ চলছে।

আন্তর্জাতিক সবজী কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিনিধি চেরি টমেটোর উদ্ভাবক জহির হোসেনের ভাষ্যমতে, আকারে ছোট হওয়ায় স্থানীয়রা এটিকে চেরি টমেটো নাম দিয়েছে। মূলত এটি বারি-১১ জাতের টমেটো। বিনা টমেটো-১০ (চেরি টমেটো) জাতটি থাইল্যান্ডের চেরি টাইপ টমেটোর লাইন (৪টম ০২১) থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশে এনে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে উন্নয়ন ঘটানো হয়। জাতটি ২০১৩ সালে নিবন্ধন করা হয়। এই টমেটো খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও নানা পুষ্টিগুণে ভরপুর। বছরের বারমাসই এই টমেটো চাষযোগ্য।

ফলে ঠাসা চেরি টমেটো গাছ
চিত্র: ফলে ঠাসা চেরি টমেটো গাছ
চেরি টমেটো চাষ পদ্ধতি:

চেরি টমেটোর চাষাবাদ অনেকটা আমাদের দেশীয় জাতের অন্যান্য টমেটোর মতই। সব ধরণের মাটিতে চেরী টমেটোর চাষ করা যায়। তবে দো-আশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি বেশি উপযোগী। সাধারণত ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা টমেটোর ফলনের জন্য অধিক উপযোগী তাই বাংলাদেশে শীতকাল চেরী টমেটো চাষের জন্য উপযুক্ত সময়। তবে এই সময়টা টমেটোর প্রকৃত মৌসুম হওয়ায় বাজারে দাম একটু কম থাকে।

জমি ভালোভাবে চাষ করে এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর চারা রোপণের উপযুক্ত হয়। চারা রোপণের দূরত্ব সারি থেকে সারি ৫৫-৬০ সেন্টিমিটার, চারা থেকে চারার দূরত্ব ৪০-৪৫ সেন্টিমিটার হওয়া ভালো। নভেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত চারা রোপন করা যায়।

অত্যধিক পরিমাণে ফলন হওয়ায় গাছের পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সার প্রয়োগ করতে হবে। গোবর বা কম্পোস্ট সার বিঘা প্রতি ৭০০-৮০০ কেজি হারে দিতে হবে। টিএসপি, ইউরিয়ার পরিবর্তে ডিএপি ৮০ থেকে ৯০ কেজি। এমপি ৩০ থেকে ৪০ কেজি। তবে এমওপি সার পুরো সিজনে ৩-৪ বারে প্রয়োগ করা ভাল।

চেরী টমেটোর ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
চিত্র: চেরী টমেটোর ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক
পরিচর্যা:

যেহেতু এই টমেটো গাছ লতানো উদ্ভিদ তাই গাছ বড় হওয়ার সাথে সাথেই মাচান করে দিতে হবে এবং গাছ শক্ত লাঠির সাথে বেধে দিতে হবে। এজন্য গাছের ১-১.৫ ফুট পর্যন্ত কোন ডাল রাখা যাবে না। নিয়মিত নিড়ানী দিতে হবে এবং মাটির উপরিভাগ আলগা করে দিতে হবে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশের সুবিধাসহ মাটি রস বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ৪ থেকে ৬ বার সেচ দিতে হবে। তবে চারা লাগানোর ৩ থেকে ৪ দিন পর হালকা এবং পরবর্তীতে প্রতি কিস্তি সার প্রয়োগের পর সেচ দিতে হবে।

পোকামাকড় প্রতিরোধ:

মূলত দুটি পোকা টমেটোর প্রধান শত্রু, তাহলো জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা। জাব পোকা টমেটোর গাছের পাতা, কচি ডগা ও কান্ড থেকে রস শুষে খেয়ে গাছের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং গাছে মোজাইক রোগ ছড়ায়। এ পোকা দমনে ১০০০ লিটার পানির সাথে রগোর এল-৪০/ সাইফানন ৫৭ ইসি বা ক্লাসিক-২০ ইসি মিশিয়ে প্রতি হেক্টর জমিতে স্প্রে করতে হবে। অন্যদিকে ফল ছিদ্রকারী পোকার শুককীট টমেটো ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে ফলন নষ্ট করে ফেলে। এ পোকা দমনের জন্য প্রথমত আক্রান্ত পাতা ও ফল সংগ্রহ করে আগুনে পুড়িয়ে বা মাটিতে পুতে ফেলে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। যদি বেশি পরিমাণে আক্রান্ত হয় তবে ফরাটাপ বা কেয়ার-৫০ এসপি দুই গ্রাম হারে প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে সারা ক্ষেতে ভালোভাবে স্প্রে করতে হবে। এছাড়াও বাইকাও-১ প্রয়োগ করে পোকা দমন করা যেতে পারে।

বাইরের ন্যায় ভিতরটাও টুকটুকে লাল
চিত্র: বাইরের ন্যায় ভিতরটাও টুকটুকে লাল
রোগ বালাই দমন:

প্রত্যাশিত ফলন পেতে হলে রোগ বালাইয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। লাল মাটিতে চাষ করলে টমেটোর ঢলে পড়া রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশী থাকে সেজন্য চাষ করার আগে জমি নির্বাচনে সতর্ক হতে হবে এবং পরিমিত সেচ দিতে হবে। টমেটোর আগা ধ্বসা রোগের ফলে গাছের পাতা এক সময় সম্পূর্ন শুকিয়ে যায় যা আপনার স্বপ্নকে একেবারেই ধুলিস্যাত করে দিতে পারে। তাই রোগমুক্ত বীজ ও চারা রোপনের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করতে হবে। টমেটোর নাবী ধ্বসা রোগের কারণ ছত্রাক। এ রোগ অনেকটা আগা ধ্বসা রোগের মত তাই একই রকম রোগ দমনে একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। ভাইরাসের কারণে টমেটোর মোজাইক রোগ এবং বুশি স্টান্ট রোগে আক্রান্ত গাছ দেখামাত্র তুলে ধ্বংস করতে হবে এবং প্রয়োজনে কৃষিবিদদের পরামর্শ নিতে হবে। টমেটোর শেকড়ের গিট রোগে হেক্টরপ্রতি ৬০ কেজি ফুরাডান ৫ জি বা মিরাল ৩জি প্রয়োগ করতে হবে।

ফলন:

সঠিকভাবে চাষ করে চেরি টমেটো কৃষকের দুহাত ভরে দেয়। এই টমেটোর গাছে ফুল ও ফল এত বেশি হয় যা অন্য কোনো ফসলের ক্ষেত্রে হয়না। ধারণা করা হচ্ছে এর প্রতিটি ফুল থেকেই ফল হয়, কোনো একটি ফুল নষ্ট হয় না। গাছে এতটাই ফল আসে যে ফলের ভারে টমেটো গাছ মাটির সঙ্গে নুয়ে পড়ে, তাই বাঁশের মাচা করে প্রতিটি গাছকে সোজা করে রাখতে হয়। বিঘা প্রতি চেরি টমেটোর ফলন ৫ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে !

বাজারে অন্য সবজীর চেয়ে চেরি টমেটোর তুলনামূলক দামও বেশ ভালো। স্থানীয় বাজারে ভরা মৌসুমে এই টমেটো প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হয়। জেলা শহরে বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা কেজি আর ঢাকাতে বিক্রি হচ্ছে ১শ থেকে ১শ ২০ টাকা কেজি দরে। এর বাইরে অমৌসুমী সবজী হিসেবে চাষ করলে প্রতি কেজি ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে টমেটো তুলতে হয়। টমেটো তোলার পর এক সপ্তাহের অধিক সময় কোনো কিছু ছাড়াই ঘরে সংরক্ষণ করা যায়, কোনো টমেটো নষ্ট হয় না এবং গুনমান অক্ষুন্ন থাকে।

ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

Molla Masum

নির্বাহী সম্পাদক

সফলখামারী.কম