জৈব সার ব্যবহার না করে আমরা বিভিন্ন আবাদে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে থাকি। এই সার ফসলের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটালেও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে থাকে। অন্যদিকে আমাদের বাসাবাড়ীতে প্রতিদিন সবজীর উচ্ছিষ্ট বা ফলের খোসা থেকে সৃষ্ট আবর্জনা আমাদের চারপাশের পরিবেশ দূষণ করে চলছে। অথচ আপনি যদি একটু সতর্ক হন তাহলে এইসব ফলমূল ও শাক সবজীর উচ্ছিষ্ট দিয়ে তৈরি সার দিয়েই পূরণ করতে পারেন ফসলের পুষ্টি চাহিদা।
প্রথমেই জৈব সার বিষয়ে একটু ধারনা দেয়া যাক। জৈব সারে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে। যেমন: নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম ও অন্যান্য উপাদান। এসব উপাদানের উপর ভিত্তি করে জৈব সারকে প্রধানত ৪ ভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে- নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার, ফসফরাস সমৃদ্ধ জৈব সার, পটাস সমৃদ্ধ জৈব সার ও সাধারণ জৈব সার। কোনো কোনো জৈব সারে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এগুলোকে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার বলে। অনুরুপভাবে যেসব জৈব সারে ফসফরাসের পরিমাণ বেশি থাকে সেগুলোকে ফসফরাস সমৃদ্ধ জৈব সার বলে এবং পটাশের মাত্রা বেশি থাকলে তাকে পটাশ সমৃদ্ধ জৈব সার বলে। আবার যেসব জৈব সারে অনেকগুলো উপাদান থাকে তাকে সাধারণ জৈব সার বলে।
জৈব সার তৈরিতে ডিমে খোসা:
ডিমের খোসাতে আছে নাইট্রোজেন ও কিছুটা ফসফরিক অ্যাসিড ও ক্যালসিয়াম। কাজেই এটিকে আমরা নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার বলতে পারি। এটি আপনার গাছের ইউরিয়ার অভাব পূরণ করবে। ফলে গাছের ডালপালা, কান্ড ও পাতার বৃদ্ধি সাধন হবে। এটি গাছকে গাঢ় সবুজ রং দান করবে। অর্থাৎ মাটির পুষ্টির জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন তার অনেকটুকুই ডিমের খোসায় পাওয়া যায়। ডিমের খোসা গাছে ব্যবহারের জন্য প্রথমে তা রোদে শুকিয়ে গুড়ো করে নিতে হবে। তবে তা অবশ্যই কাচা ডিমের খোসা হতে হবে। তারপর তা মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে।
চা পাতা:
চা তৈরি করার পর যে উচ্ছিষ্ট চা পাতা থাকবে তা দিয়েই সার তৈরি করা যাবে। চা পাতা যেকোনো গাছের জন্য উৎকৃষ্ট সার। এ চা পাতায় বেশ কিছুটা নাইট্রোজেন ও অল্প পরিমাণ পটাসিয়াম অবশিষ্ট থাকে। সুতরাং এটাও নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ জৈব সার। এগুলো গাছের ইউরিয়ার অভাব পূরণ করবে। তবে চা পাতা ব্যবহারের পূর্বে তা পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। কারণ অনেকে চা তৈরির সময় তাতে চিনি ব্যবহার করে থাকেন। এতে করে পিপড়ার আক্রমণ হতে পারে। চা পাতা প্রতিদিন না দিয়ে জমিয়ে একত্র করে ১০-১৫ দিন পর পর গাছের গোড়ার মাটি খুঁড়ে ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
কলার খোসা:
ফুলের গাছের বৃদ্ধির জন্য এটা বেশ কার্যকরী। কলার খোসায় আছে প্রচুর পরিমাণ পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজের মত খনিজ পদার্থ। এছাড়াও এতে আছে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি। কাজেই একে আমরা সাধারণ জৈব সার বলতে পারি। কলার খোসা আলাদা একটা পাত্রে মাটি খুঁড়ে তার ভিতর ৩-৫ দিন রেখে দিতে হবে। খোসা একটু পচে গেলে সেটা মাটিসহ ফুল গাছের গোড়ায় ছিটিয়ে দিতে হবে।
কলার খোসার মত শাক সবজীর শিকড় ও পাতায় বিভিন্ন উপাদান থাকে। কাজেই এটিও সাধারণ জৈব সার। এটিও ব্যবহারের পূর্বে কয়েকদিন মাটির নীচে পুঁতে রেখে তারপর ব্যবহার করলে ভালো ফল লাভ করা যায়। তবে যেসব ফলের খোসায় সাইট্রিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে যেমন: লেবু, আমড়া ইত্যাদির খোসা গাছের গোড়ায় না দেওয়াই ভালো।
কম্পোস্ট সার:
এই সার বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়। আবার নিজেরাও বাড়িতে তৈরি করা যায়। কম্পোস্ট কথাটি ল্যাটিন শব্দ। যার অর্থ কয়েকটি জিনিস একত্রে মেশানো। পাশাপাশি দুইটা গর্ত করে তার উপরে চালা দিতে হবে। যাতে বৃষ্টির পানি গর্তের মধ্যে না পড়ে। তারপর একটি গর্তের মধ্যে বাড়ির বিভিন্ন আবর্জনা (পলিথিন বাদে) যেমন: ফলের খোসা, শাক সবজীর খোসা, মাছের আইশ ও অন্যান্য আবর্জনা ঐ গর্তে ফেলতে হবে। ময়লা আবর্জনায় গর্ত ভরে যাওয়ার পর ঐ গর্ত মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। তারপর পাশের গর্তে একই নিয়মে ময়লা আবর্জনা ফেলতে হবে। ১.৫-২ মাসের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে যায় জৈব সার। মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এর জুড়ি নেই। তদুপরি রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরতা কমায়। এটা যেকোনো গাছে অনায়াসেই ব্যবহার করা যায়।
কাঠ কয়লা:
কাঠ কয়লাতে থাকে মূলত কার্বন। যা গাছের সয়িষ্ণুতা ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং গাছকে মজবুত করে। যারা বনসাই তৈরি করতে চান তাদের এটা অবশ্যই প্রয়োজন হবে। ব্যবহারের পূর্বে এটা ভালোভাবে গুড়ো করে নিতে হবে।
ইটের গুড়ো:
এটিও মাটির সয়িষ্ণুতা বৃদ্ধি করে। এটিও বনসাইয়ের জন্য প্রয়োজন হয়।
গোবর:
গোবর একটি সাধারণ জৈব সার। এটি বহুল প্রচলিত একটি সার। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য সারের চেয়ে গোবর সারের ব্যবহার অনেক বেশি এবং গুণাগুণের পরিমাণ অধিক। যেকোনো গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে মাটির এক তৃতীয়াংশ গোবর সার ব্যবহার করতে হবে।
পচঁনশীল বর্জ্য:
বাসাবাড়িতে প্রতিদিন যেসব ময়লা আবর্জনা তৈরি হয় যার বেশির ভাগই পড়ে থাকে এখানে সেখানে। ফলে তা যেমন দূগর্ন্ধ ছড়ায় তেমনি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিবেশ। এসব আবর্জনা যখন মাথা ব্যথার কারণে হয়ে দাড়িয়েছিল তখনই তা পরিণত হয়েছে সম্পদে। পচনশীল দ্রব্য (ফলের খোসা, শাক সবজীর উচ্ছিষ্ট, শিশুদের খাবারে উচ্ছিস্ট) কোনো ড্রামে কয়েকটি স্তরে রেখে তার মধ্যে মাটি দিতে হয়। যা ২-৩ মাসের মধ্যে জৈব সারে পরিণত হয়। এসব সারে উৎপাদিত হয় নিরাপদ শাক সবজী।
সরিষার খৈল:
সরিষার খৈল ভালোভাবে গুড়ো করে মাটির সাথে মিশিয়ে জৈব সার তৈরি করতে হবে। মাটি গুড়ো করে ঝুঁড়ি বা চালুনি দিয়ে ছেকে নিয়ে ময়লা আবর্জনামূক্ত মাটি নিতে হবে। একইভাবে খৈল গুড়ো করে ছেকে নিতে হবে। মাটি ও খৈলের অনুপাত হবে সমান সমান। অর্থাৎ ২ কেজি মাটির সাথে ২ কেজি খৈল মিশ্রন করতে হবে। এরপর ঐ মাটি ও খৈলের মিশ্রন কোনো বস্তায় মুখ আটকিয়ে অথবা গামলায় রাখলে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। প্রতিদিন দিনের বেলায় যতক্ষণ রোদ থাকবে ততক্ষণ রোদে ভালোভাবে ঐ মিশ্রনকে ৭দিন শুকাতে হবে। পালাক্রমে এইভাবে ৭দিন শুকানোর পর তৈরি হয়ে যাবে জৈব সার। এরপর ঐ জৈব সার যেকোনো গাছের গোড়ায় ১ মুঠো করে ব্যবহার করতে হবে।
খামারজাত সারে মলের চেয়ে মূত্রভাগে অধিকতর খাদ্য উপাদান থাকে। বিশেষ করে নাইট্রোজেন ও পটাসিয়াম। অনেকের একটা ভুল ধারনা আছে যে গবাদি পশুর মূত্র দিলে গাছ মরে যায়। যা মোটেও ঠিক নয়। আবার অনেকে গাছের গোড়ায় মাছের আঁইশ দিয়ে থাকেন। যা গাছের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য গাছের গোড়ায় মাছের আঁইশ দেওয়া ঠিক নয়।