পোল্ট্রির মোট ১১টি প্রজাতির মধ্যে একটি হলো তিতির পাখি, যার ইংরেজী নাম Guinea fowl। শোভাবর্ধনকারী পাখি (Ornamental bird) হলেও সুস্বাদু মাংস এবং ডিমের জন্য শত শত বৎসর যাবত তিতির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে। আফ্রিকা মহাদেশে উৎপত্তি এ পাখিটি আগে বাংলাদেশের প্রধানত রাজশাহী, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নওগাঁ, নরসিংদী, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল অঞ্চলে বিশেষ ভাবে চোখে পড়ত। স্থানীয় জনগণ এই পাখিকে চীনা মুরগী নামে ডাকত এবং গ্রামীণ পরিবেশে হাঁস-মুরগীর সাথে পালন করত। বর্তমানে সৌখিন ব্যক্তিরা এদেরকে পালন করে থাকেলেও বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে তিতির পালন ব্যাপক সম্ভবনা রয়েছে।
তিতির ব্যবস্থাপনা:
(ক) ব্রুডিং-মুরগির বাচ্চার তুলনায় তিতিরের বাচ্চা ঠান্ডায় অধিক সংবেদনশীল। সেজন্য প্রথম সপ্তাহে উচ্চ ব্রুডিং তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত ব্রুডিং তাপমাত্রা ৩৭º সে. এবং চতুর্থ থেকে পঞ্চম সপ্তাহ পর্যন্ত ৩৬º সে.-এ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
(খ) বাসস্থান ব্যবস্থা-এদেরকে মুক্ত অবস্থায় (Free range), আধা-মুক্ত (Semi-intensive) এবং বন্ধ (Battery cages & deep litter) অবস্থায় পালন করা যায়। বয়স ভেদে প্রতিটি তিতিরের জন্য জায়গার পরিমাণ নিম্নরূপঃ
বয়স | ০-৪ সপ্তাহ | ৫-৮ সপ্তাহ | ৯-১৩ সপ্তাহ | পূর্ণ বয়স্ক |
জায়গা | ০.৫ বর্গফুট | ০.৭৫ বর্গফুট | ১.০ বর্গফুট | ২-২.৫ বর্গফুট |
(গ) খাদ্য এবং পানি-বাড়ন্ত তিতিরের সাপ্তাহিক খাদ্য এবং পানি গ্রহণের পরিমাণ নিচে তালিকা আকারে দেয়া হলো।
(ঘ) খাদ্য প্রস্তুতকরণ।
উৎকর্ষতার বৈশিষ্ট্য:
দৈহিক ওজন, খাদ্য গ্রহণ এবং খাদ্য রূপান্তর দক্ষতার (F.C.R) ভিত্তিতে তিতিরের উৎকর্ষতার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপঃ
প্যারামিটার | বয়স (সপ্তাহ) | |||||||
০-৪ | ৫-৮ | ৯-১১ | ১২ | ১৩ | ০-১১ | ০-১২ | ০-১৩ | |
দৈহিক ওজন(গ্রাম) | ৩৮০ | ৫৯০ | ৪০০ | ১১০ | ১০০ | ১৩৭০ | ১৪৮০ | ১৫৮০ |
খাদ্য গ্রহণ(গ্রাম) | ৬৭০ | ১৬৯০ | ১৭৩৫ | ৬৩০ | ৬৩৫ | ৪০৯৫ | ৪৭২৫ | ৫৩৬০ |
খাদ্য রূপান্তর দক্ষতা | ১.৭৬ | ২.৮৬ | ৪.৩৪ | ৫.৭৩ | ৬.৩৫ | ২.৯৯ | ৩.১৯ | ৩.৩৯ |
বিঃ দ্রঃ খাদ্যে শক্তি মাত্রা ৩০০০ কিলো ক্যালরি বিপাকীয় শক্তি কেজি এবং সহনীয় তাপমাত্রা ২০ºসে.।
বাংলাদেশে বিদ্যমান তিতির পাখির সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
বাংলাদেশে যে তিতির পাখি পাওয়া যায় সেটি পার্ল ধরণের। এর সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলোঃ- রং ধুসর বর্ণের এবং পালকের উপর নিয়মিত ভাবে ফোটা ফোটা সাদা দাগ থাকে, ডিমের রং হালকা বাদামি থেকে ঘন বাদামি রং এর হয় ও ডিম এর গায়ে ছোট ছোট দাগ দেখা যায়, ডিম সাধারণত লাঠিম বা কনিকেল আকৃতির হয়, ডিমের ওজন ৩৮-৪৪ গ্রাম এর মধ্যে হয়ে থাকে,পুরুষ পাখির মাথার হেলমেট বা মুকুট একটু বেশী উঁচু স্ত্রী পাখির তুলনায়, পায়ের রং একটু কালচে ধরণের, একটি পূর্নাঙ্গ স্ত্রী পাখির ওজন ১৩০০-১৫০০ গ্রাম ও পুরুষ পাখির ওজন ১৬০০-১৭০০ গ্রাম হয়ে থাকে, এ পাখির ডিম প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পদ্ধতিতে ফোটানো যায়, ডিম ফুটতে ২৭-২৮ দিন সময় লাগে।
অন্যান্য পোল্ট্রি প্রজাতির তুলনায় তিতির পাখি পালনের সুবিধা সমুহ:
তিতির পাখির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য পাখির তুলনায় বেশি। সংক্রামক বা পরজীবীঘটিত রোগ কোনটাই সহজে আক্রান্ত করতে পারেনা। মাইকোটক্সিন ও আফলাটক্সিনের প্রতি অধিক সহনশীল। এদেও খাদ্য খরচ তুলনামূলকভাবে কম। একটি পূর্ণবয়স্ক তিতির দৈনিক ১১৮-১২০ গ্রাম খাবার খায়। কচি ঘাস, পোকামাকড়, সবজি এদের প্রিয় খাদ্য। গ্রামীণ পরিবেশে এসবের অভাব নেই। সম্পূরক খাদ্যের পরিমান কম লাগে। এদের জন্য ভাল মানের ঘর লাগে না এবং খুব বেশী সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না। ডিমের খোসা অত্যন্ত শক্ত, প্রায় ০.৪৮-০.৫০ মি.মি পুরু। বাজারে পরিবহন অথবা ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা কম থাকে। আলাদা কোন ভ্যাকসিন বা ঔষধ লাগে না। শারীরিক বৃদ্ধিও হার বেশ ভালো এবং মাংস অনেক সুস্বাদু ও পুষ্ঠিকর। ডিমের আকৃতি তুলনামূলক ছোট বলে বাচ্চারা এটি খেতে পছন্দ করে। তিতির পাখির ডিম ও মাংস খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য কোন ধর্মীয় বাধা নেই। একটি দেশী মুরগী যেখানে বৎসরে ৫০-৬০ টি ডিম দেয়, সেক্ষেত্রে একটি তিতির পাখি ১০০-১২০ টি ডিম দেয়। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে এরা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।
বাংলাদেশে তিতির পাখি পালনের সম্ভাবনা:
সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায় এ পাখির সংখ্যা ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে জীববৈচিত্র্যের বিবেচনায় অদূর ভবিষ্যতে এ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে হুমকির সম্মুক্ষীন হতে পারে। পোল্ট্রি ফার্মে কৃত্রিম উপায়ে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব (হ্যাচাবিলিটির ৬৫%)। কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চার লালন পালন এবং পরবর্তীতে বাড়ন্ত বাচ্চা সম্পূর্ন আবদ্ধ ঘরে তা পালন করা যায়। বাচ্চা বয়সে ব্রয়লার স্টারটার খাদ্য খাওয়ানো যায়। তিতির পাখির আমিষের চাহিদা বেশি বলে সিনথেটিক এমাইনো এসিড ও পরবর্তীতে বাড়ন্ত বয়সে লেয়ার খাদ্য খাওয়ানো যায়। বিভিন্ন দেশের গবেষণা থেকে দেখা গেছে তিতির পাখি সাধারণত ৬-৭ মাস বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পোল্ট্রি ফার্মে তিতির পাখি ২০ সপ্তাহ বয়সে ডিম দেয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া তিতির পাখির জন্য উপযুক্ত বলে সম্ভবত আগে ডিম পাড়া শুরু করে। বাংলাদেশে বিদ্যমান পার্লজাতীয় তিতির পাখি প্রায় সারাবছর বিরতি দিয়ে ডিম পাড়ে। তবে বসন্তকালে ডিম পাড়ার হার বেশি। বাংলাদেশে গ্রামীণ পরিবেশে দেশী হাঁস মুরগীর সাথে তিতির পাখি পালনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
তিতির পালনে প্রতিবন্ধকতা:
বাংলাদেশ তিতির পাখি হ্রাস পাওয়ার পেছনে নানা কারণ লক্ষ্য করা যায়। পোল্ট্রির প্রজাতি হিসেবে হাঁস-মুরগি বা কোয়েল কবুতরের চেয়ে তাদের রয়েছে কিছু স্বতন্ত্র বংশগত বৈশিষ্ট্য, যার কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে চলতে পারে না। যেমন অল্প বয়সে অধিক বাচ্চা মৃত্যুর হার। বলা হয়ে থাকে তিতির পাখি “আদর্শ মা”নয়। প্রাকৃতিকভাবে উমে আসা মা তিতির পাখির পেটের নিচে তা দিয়ে ডিম ফোটানোর ক্ষেত্রে একদিকে যেমন ডিমে তা দেয়ার সময় তারা খুব যত্নশীল নয়, অন্যদিকে পেটের নীচে দেয়া ৮-১০টি ডিমের মধ্যে প্রথম ১-২টি ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার সাথে সাথে তিতির অবশিষ্ট ডিম ফেলে চলে যায়। সেগুলি থেকে আর বেশি বাচ্চা ফোটে না। সাধারণত তিতির পাখি একটু বোকা প্রকৃতির। স্বভাবগতভাবে এরা ঝোপঝাড়, জঙ্গল পছন্দ হওয়ায় ছোট বাচ্চা নিয়ে সেখানে ঘুরে বেড়ানোর সময় প্রায়শই শিয়াল, কুকুর, চিল বা বাজ পাখি সহ নানা ধরণের শিকারীর কবলে পড়ে বাচ্চা মারা যায়। মা তিতির বাচ্চাদের রক্ষা করতে পারে না। বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার সাথে সাথে Leg paralysis বা পা খোঁড়া হয়ে যাওয়া রোগের প্রবণতা প্রায়শই পরিলক্ষিত হয়। ডিপ লিটার পদ্ধতিতে বাচ্চা পালনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাচ্চাগুলো লিটারের নোংরা খায়। ফলে পরিপাকতন্ত্রের নানান সমস্যা দেখা দেয়।বাচ্চাদের খাদ্য তালিকায় প্রচুর আমিষ বিশেষ করে লাইসিন এবং সালফারযুক্ত এমাইনো এসিডের প্রয়োজন হয় যা সবসময় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।খাঁচা পদ্ধতিতে (Battery/Cage) পালনের সময় এরা উড়াউড়ি করে। ফলে এদের হেলমেট ও পা-এ ক্ষতের সৃষ্টি হয়।
তিতির পালনে সমস্যা সমাধানের উপায়:
মেঝেতে তিতির পালনের সময় পাটের বস্তা ব্যবহার করতে হবে।খাঁচার তুলনায় মেঝেতে পালন বেশি লাভজনক ও সুবিধাজনক। তিতিরের ডিম দেশীয় মুরগির সাহায্যে ফুটানো যায়।আমিষের চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্যে অতিরিক্ত আমিষ সরবরাহ করতে হবে। খাদ্যের সাথে নিয়মিত ভিটামিন এবং মিনের্যালস্ দিতে হবে।
রোগলক্ষণ, উপসর্গ ও চিকিৎসা:
তিতিরের বিভিন্ন রোগ, এদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় নিচে বর্ণিত হলো।
বালাই/ রোগ | লক্ষণসমূহ | চিকিৎসা |
উকুন/ফ্লি | -দুর্বলতা, দৈহিক ওজন কমে যাওয়া, ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়, ডিম অনুর্বর(Infertile) হয়, মাথা ও ঘাড়ের চারপাশে উকুন/ ফ্লি দেখা যায়। | -এসিটালিক (Actellic)
তরল বা পাউডার -কারবাডাস্ট (Karbadust) |
গোলকৃমি | -ডিম উৎপাদন হ্রাস পায়।
-পানির মত পাতলা পায়খানা হয়, ক্ষুধামন্দ্যা দেখা যায়। |
-রুজিন (Ruzine)
-এসকারেক্স (Ascarex) |
রক্তআমাশয় (coccidiosis) | -রক্তমিশ্রিত পাতলা পায়খানা।
-ওজন হ্রাস পায়, পালক অনুজ্জ্বল হয়। |
-এমিডিওস্ট্যাট (Amidiostat)
-এমপ্রোলিয়াম-(Amprulium) |
ট্রাইকোমোনিয়াসিস | -বাচ্চার ওজন হ্রাস পায়, ঝুঁটি (wattle)কালো হয়, মুখ থেকে লালা ঝরে। | -এমিডিওস্ট্যাট (Amidostat) |
বাজারজাতকরণ ও উপকারিতা:
তিতির ৭-৮ মাস বয়সে বাজারজাতকরণের উপযোগী হয়। এদের মাংস খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। বিলাসবহুল হোটেল, রেস্তোরা এবং বড় বড় ভোজসভায় এদের মাংসের যথেষ্ট সমাদর আছে। এদের নরম পালক শীতকালীন পোষাক ও বিছানা প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত হয়। এটা একটি রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে গণ্য হতে পারে। শুধু তাই নয় এটি পালন করে দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন হবে।
পরিশেষে….
তিতির পালন বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। তাই এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তিতির পাখি পালনের গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। সেটি সম্ভব হলে বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে তিতির পাখি দেশী হাঁস মুরগীর সম্পূরক হিসাবে পালন করে মাংস ও ডিমের চাহিদা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য রক্ষার ক্ষেত্রে এটি তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিজ্ঞানভিত্তিক তিতির পালন করে দারিদ্র্য বিমোচন, পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।