বাংলাদেশে কচুর মুখী ও কচুর লতি জনপ্রিয় সবজি। কচু গাছের কোনো কিছুই বাদ যায় না। এ ছাড়া কচু, কচু শাক, কচুর লতি সবকিছুই পুষ্টিকর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পুষ্টিকর ও বহুমূখী ঔষধী গুণ সম্পন্ন সবজী কচু। শহর নগরে দিন দিন বাড়ছে কচুর লতির চাহিদা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পানিকচুর চাষ হচ্ছে, যা থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন লতি পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করা হলে উৎপাদনের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। সারা বছরব্যাপী কচুর লতির আবাদ করা যায়।
জাত: বাংলাদেশে লতি কচুর অনেক জাত থাকলেও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অবমুক্ত লতিকচুর জাত ‘লতিরাজ’ চাষ বেশ লাভজনক।
মাটি: জৈব পদার্থসমৃদ্ধ পলি দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ। বেলেমাটিতে রস ধরে রাখা যায় না বলে চাষের জন্য এ ধরনের মাটি ভালো নয়।
কচুর লতি চাষে জমি নির্বাচন:
মাঝারি নিচু থেকে উঁচু যেকোনো জমি, বৃষ্টির পানি জমে না, কিন্তু প্রয়োজনে সহজেই পানি ধরে রাখা যায় এমন জমি নির্বাচন করতে হবে।
জমি তৈরি: কচুর লতি পানিকচু থেকে পাওয়া যায়। লতি উৎপাদনের জন্য পানিকচুর জমি শুকনো ও ভেজা উভয় অবস্থাতেই তৈরি করা যায়। শুকনোভাবে তৈরি করার জন্য ৪/৫টি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করতে হবে। ভেজা জমি তৈরি করার জন্য ধান রোপনের জন্য জমি যেভাবে কাঁদা করা হয় সেভাবেই তৈরি করতে হয়।
রোপণ সময়: খরিপ মৌসুমে কচুর লতি পাওয়া যায় বা সংগ্রহ করা যায় বলে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস রোপণের জন্য উপযুক্ত সময়।
বংশবিস্তার: পূর্ণবয়স্ক পানিকচুর গোড়া থেকে যেসব ছোট ছোট চারা উৎপন্ন হয় সেগুলোই বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
চারা রোপণ পদ্ধতি: পানিকচুর চারা কম বয়সী হতে হয়। ৪-৬ পাতার সতেজ চারাগুলোই রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হয়। রোপণের সময় চারার ওপরের ২-৩টি পাতা রেখে নিচের বাকি সব পাতা ছাঁটাই করে দিতে হয়। চারার গুঁড়ি বা গোড়া বেশি লম্বা হলে কিছুটা শিকড়সহ গুঁড়ির অংশবিশেষ ছাঁটাই করে দেয়া যেতে পারে। সারি থেকে সারি ৬০ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছ ৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণে মাটির গভীরতা ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার রাখতে হয়।
পরিচর্যা: গুঁড়ি থেকে চারা উৎপন্ন হওয়ার পর যদি মূল জমিতে চারা রোপণে দেরি হয় তাহলে সেগুলো ভেজা মাটি ও ছায়া আছে এমন স্থানে রেখে দিতে হয়। চারাগুলো আঁটি বেঁধে বা কাছাকাছি রাখতে হয়। রোপণের সময় বা পরে কিছু দিন পর্যন্ত জমিতে বেশি পানি থাকার কারণে যাতে চারা হেলে না পড়ে সে জন্য মাটি কাদা করার সময় খুব বেশি নরম করা উচিত নয়। গাছ কিছুটা বড় হলে গোড়ার হলুদ হয়ে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া পাতা সরিয়ে ফেলতে হয়। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে জমি পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। রোপণের এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ক্ষেতে কোনো প্রকার আগাছা যেন না থাকে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। পানি কচুর গাছে লতি আসার সময় ক্ষেতে পানি রাখা উচিত নয়। তবে একেবারে শুকনো রাখলেও আবার লতি কম বের হয় বা লতির দৈর্ঘ্য কম হয়। সে জন্য জো অবস্থা রাখতে হয়।
সার প্রয়োগ: হেক্টর প্রতি জৈব সার ১৫ টন, ইউরিয়া ১৫০ কেজি, টিএসপি ১২৫ কেজি, এমওপি ১৭৫ কেজি ব্যবহার করতে হয়। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরি শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে রোপণের ৩০ দিন ও ৬০ দিন পর সারির মাঝে ছিটিয়ে দিয়ে হালকা সেচ দিতে হয়। জমিতে দস্তা ও জিংকের অভাব থাকলে জিংক সালফেট ও জিপসাম সার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়।
সেচ ও নিকাশ: এটি একটি জলজ উদ্ভিদ হলেও দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে লতি উৎপাদনের সময় পানি ধরে রাখা ঠিক নয়। পানি থাকলে কম বা না থাকলে (শুধু জো অবস্থা থাকলে) বেশি লতি বের হয়।
রোগ ব্যাধি ও দমন পদ্ধতি: লতি রাজ কচুর ২টি রোগ আছে। এক: পাতায় ছোপ ছোপ শুকনো দাগ পড়ে। এ রোগ দেখা দেওয়ার সাথে সাথেই ডাইফেন এম ৪৫ অথবা রিদুমিল গোল্ড প্রয়োগ করতে হয়।যেহেতু কচু পাতা পানি ধরে রাখতে পারে না সেহেতু ছত্রাক নাশক মিশানোর সময় তাতে ডিটারজেন্ট অথবা সাবানের গুড়া মিশিয়ে দিতে হয়। যারফলে ঔষধটা গাছের গোড়ায় ছিটালে পাতায় লেগে থাকবে। দ্বিতীয়ত: পাতায় ব্রাইট বা পাতা পোড়ানো রোগ হয়। এ রোগটি হলেও অনুরুপভাবে ডাইফেন এম ৪৫ অথবা রিদুমিল গোল্ড ১৫ দিন অন্তর অন্তর প্রয়োগ করতে হয়।
কচুর লতির গুণাগুণ:
আয়রন: কচুর লতিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন। রোগ প্রতিরোঘ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গর্ভস্থ অবস্থা, খেলোয়ার, বাড়ন্ত শিশু, কেমোথেরাপি পাচ্ছে এমন রোগীদের জন্য কচুর লতি ভীষণ উপকারী। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম। ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে ও চুলের ভঙ্গুরতা রোঘ করে।
ফাইবার: এই সবজিতে ডায়াটারি ফাইবার বা আঁশের পরিমাণ খুব বেশি। এই আঁশ খাবার হজমে সাহায্য করে, দীর্ঘ বছরের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, যেকোনো বড় অপারেশনের পর খাবার হজমে উপকারী পথ্য হিসেবে কাজ করে এটি।
ভিটামিন: ভিটামিন “সি”ও রয়েছে কচুর লতিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে, যা সংক্রামক রোগ থেকে আমাদের দূরে রাখে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে করে দ্বিগুণ শক্তিশালী। ভিটামি “সি” চর্ম রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে।
কোলেস্টেরল বা চর্বি: কিছু পরিমাণ ভিটামিন “বি” হাত, পা, মাথার উপরিভাগে গরম হয়ে যাওয়া, হাত-পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরা বা অবশ ভাব এর সমস্যাগুলো দূর করে। মস্তিষ্কে সুষ্ঠুভাবে রক্ত চলাচলের জন্য ভিটামিন “বি” ভীষণ জরুরি। এতে কোলেস্টেরল বা চর্বি নেই। তাই ওজন কমানোর জন্য কচুর লতি খেতে বারণ নেই।
আয়োডিন: খাবার হজমের পর বর্জ্য দেহ থেকে সঠিকভাবে বের হতে সাহায্য করে। তাই কচুর লতি খেলে অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা থাকে খুব কম। আয়োডিনও বসতি গড়েছে কচুর লতিতে। আয়োডিন দাঁত, হাড় ও চুল মজবুত করে।
ডায়াবেটিস: অনেকেই কচুর লতি খান চিড়িং মাছ দিয়ে। চিংড়ি মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল। তাই যারা হৃদরোগী, ডায়াবেটিস ও উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল জনিত সমস্যায় আক্রান্ত বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন তারা চিংড়ি মাছ, শুঁটকি মাছ বর্জন করুন। ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকলে অল্প পরিমাণে চিংড়ি মাছ খেতে পারেন কচুর লতিতে। বড় চিংড়িতে ফ্যাটের পরিমাণ বেশি, তাই বড় চিংড়ি পরিহার করা ভালো। কচুর লতি রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ায় না। তাই ডায়াবেটিসের রোগীরা নি:সংকোচে খেতে পারেন কচুর লতি।